Tuesday 24 March 2020

রাতের হলুদ ট্যাক্সি

এই লেখাটা লিখেছিলাম আজ থেকে ছয় বছর আগেই, জানুয়ারি ২০১৪ সাল। লিখেছিলাম কোনো সংবাদ পত্রের  লেখনী প্রতিযোগিতার জন্য, আদৌ চিঠি পৌঁছেছিল কিনা আমি জানি না আর যদি পৌঁছে গিয়েও থাকে, তাহলেও হয়তো খবরের পাতায় প্রকাশ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেনি।  তাই এই লেখা গুলো 'অপ্রকাশিত' রয়ে গেছে।  এরকম অনেক গল্প বা লেখনী আছে যা আমি এই 'অপ্রকাশিতসংকলনে যোগ করতে চলেছি। আজকের তৃতীয় লেখা যেটা আমি যোগ করছি সেটা একটা সূত্রের উপর ভিত্তি করে লেখা।  বিভাগ - রহস্য। 
Image result for yellow taxi night kolkata
Flickr



গল্পের সুত্র : "ট্যাক্সি ধরলাম অফিস এর সামনে থেকে । ক্লান্ত, তাই উঠেই সিটে শরীরটা এলিয়ে দিলাম।অনেক রাত হয়ে গেল আজ। হঠাত্ ড্রাইভার এর সিটের পিছনে লেখা ট্যাক্সির নম্বরটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম ..... "



" অনিল, কী গো ? আজ বাড়ি যাবেনা ? নাকী এখানেই থেকে যাওয়ার ইচ্ছে আছে ?" - ম্যানেজার এর গলাটা শুনতেই ঘড়ির দিকে তাকালাম ।টনক নড়ল আজ স্বাভাবিকের থেকে ৩ ঘন্টা বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে ফেলেছি ।যদিও এই উপলব্ধি প্রথম বারের নয় । কম্পিউটার  ও ডান হাতে ধরা ইঁদুরের ল্যাজ আমার জীবনের একটা প্রত্যঙ্গই বটে ।যাক ম্যানেজার সদয় হয়েছেন আমার প্রতি , তাও বা কম কীসের ?

এই সময় বেরোনো মানে যাতায়াতের টানাপড়েন । শাটল কিংবা ট্যাক্সি ই সহায় । ঐতো একটা ট্যাক্সি আসছে। চেঁচিয়ে উঠলাম "ট্যাক্সি ও ট্যাক্সি"।ট্যাক্সি দাড়াতেই জিজ্ঞেস করলাম - "১নং গেট যাবে ?"। আবছা অন্ধকারে নীরব মূর্তিটি হাঁবাচক মাথা নাড়তেই উঠে পরলাম ট্যাক্সিতে। বসতে বসতেই শরীর দিলাম এলিয়ে। রাতও হয়েছে । পেটেও পড়েনি তেমন কিছু। মেসে গিয়ে কি খাব ভাবতে ভাবতেই চোখ পড়ল ড্রাইভার এর সিটের পিছনে লেখা ছোট সাদা নম্বরগুলোর দিকে । নম্বরটা দেখেই খুব চেনা চেনা মনে হল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম - "ও ভাই এইটা কি এই ট্যাক্সির নম্বর ?" - উত্তর এলো "হাঁ" । হঠাত্ রাস্তার হ্যালোজেন আলো ট্যাক্সির ভিতরে আছড়ে পড়ায়ে ড্রাইভার এর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম । আমার বুকটা ধড়াস করে উঠলো । একটা শীতল কনকনে প্রবাহ আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নীচে নেমে আসল ।

এই মুখ আমার চেনা। এই চেনা মুখের সাথে ড্রাইভার এর চেহারা রুবি কিউবের মতন মিলে গেল। সেই দিনটাকে ভোলা যায়েনা। আজ থেকে মাস পাঁচেক আগের কথা। ম্যাক ডোনাল্ডস্ এর অর্ডার কাউন্টার এ আমার পাশের লাইন এ দাড়ানো মেয়েটির আতঙ্কিত মুখ আমার চোখে এখনো ভাসে। কাঁপা,ভয় মাখানো কন্ঠস্বরে অর্ডার দিতে এসেছিল মেয়েটি। ভীরু চোখ দুটো কেবল একটি টেবিল কেই দেখে যাচ্ছিল বার বার। শীর্ণ জীর্ণ মেয়েটির পরনে ছিল একটা অতিসাধারণ কুর্তি ও পায়েজামা। চুল ছিল এলোমেলো। মুখে আঘাত ও ক্ষতের দাগ ছিল অগুনিত। নখের আঁচর ভর্তি ছিল তাঁর ডান হাতে। বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছে ছিল সিগারেট এর ছেঁকার দাগ। আমাকে নিজের দিকে লক্ষ্য করতে দেখে ইশারায় কি যেন বলতে চেয়েছিল মেয়েটি, কিন্তু কাউন্টার থেকে হঠাত তাঁর টেবিল জিজ্ঞেস করায়ে তাঁকে আমার থেকে মুখ সরিয়ে নিতে হয়েছিল । আমি ওঁর আঙ্গুল বরাবর চোখ ঘোরাতে দেখতে পেয়েছিলাম তিনজনকে। তিনজন লোক। ভদ্রলোক বলা চলে না, তাদের চেহারা ও বেশভূষা ছিল কিঞ্চিত ভয়ানক ও রুক্ষ। বলপূর্বক মেয়েটিকে বার্গার খাবানোর চেষ্টা করছিল তাঁরা ও ফুর্তি করছিল তাঁর গায়ে হাত দিয়ে । আমি খেতে খেতে মেয়েটিকে দেখছিলাম। খুব বিকৃত লাগছিল ব্যাপারটা।

মল থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তার নির্জন দিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম ষ্ট্যান্ড এর দিকে, দেখতে পেয়েছিলাম একটি অজ্ঞান অসার মহিলা দেহ নিয়ে তিনজন পুরুষ ট্যাক্সিতে উঠছে। কাছে যেতে আবার দেখেছিলাম ওদেরকে। সেই মেয়েটি তখন জ্ঞানহারা, ওরনাহীন, অলস অবস্থায়ে পিছনের সিটে পড়ে আছে। কী জানি কী মনে হতে হঠাত্ করে ঢুকতে চেয়েছিলাম ট্যাক্সিতে। আমার আকস্মিক ও অভাবনীয় ব্যবহারে তিনজন চমকে উঠেছিল। একরকম হাতাহাতি করতে শুরু করেছিলাম আমি। কোনো ফল না ভেবে। আমাকে তিনজনে যাপটে ধরে খুব মারছিল ওঁরা। আর তখনই ট্যাক্সির ড্রাইভার আমার গলার কাছে একটা পাতলা ছুঁড়ি ধরেছিল। সেই আমার তাঁর মুখ প্রথম দেখা। শাসিয়েছিল আমাকে। তারপর কেউ খুব জোরে মাথায়ে আঘাত করাতে সব অন্ধকার হয়ে গেল। জ্ঞান যখন ফিরেছিল তখন আমি আমার বন্ধুর বাড়িতে। মেয়েটির সাথে যে কি হয়েছিল তা আমার ভাবনার অতীত। এইটুকু জানি যে সেদিন বাঁচাতে চেয়েও বাঁচাতে পারিনি সেই অসহায় মেয়েটিকে।

সেই দিনটার কথা ভাবতে ভাবতে যখন আমার কপাল ও মাথা দিয়ে ঘাম ঝরতে আরম্ভ করেছে, যখন আমার বুকের হৃদস্পন্দন দ্রুত গতিতে দৌড়তে
শুরু করেছে, ঠিক তখনি ট্যাক্সিটা দাড়িয়ে পড়ল। আমি ভীত চিত্তে ড্রাইভার এর দিকে চাইলাম। তাহলে কী ড্রাইভার আমাকে চিনতে পেরে গেছে? আজ কি সেই অমীমাংসীত প্রতিশোধ নেবে? আমার কি আজ ই শেষ দিন? - এই সব প্রশ্ন যখন আমার মগজের দরজায়ে প্রবল কড়াঘাত করছে, তখনই শুনতে পেলাম - "নেমে পড়ুন" । ভয়মিশ্রিত চোখে যখন বাইরে তাকালাম দেখলাম এয়ারপোর্ট ১নং গেট এসে গেছে। একটু হলেও স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেললাম। ভাবতে লাগলাম যে ও আমাকে দেখতে পায়েনি। একটু দম ফেলে মিটারের প্রাপ্য ডান হাত দিয়ে সামনে এগিয়ে দিলাম ড্রাইভার এর কাছে। হিসেব করে বাকিটা নিয়ে বাইরে নেমে সবেমাত্র ট্যাক্সিকে পিছনে ফেলে হাঁটা আরম্ভ করেছি, তখনই শুনতে পেলাম - "কি বাবু? উস দিন দিমাগ কা চোট ভারী থা ইয়ান নাহি? - দুনিয়া গোল আছে । ঈশ্বরের কৃপাতে হাম ফির মিলেঙ্গে। হা হা হা হা হা .....হা হা.... হা .."

হাসি মিলিয়ে গেল। ট্যাক্সি চলে গেল। আমি নিথর দাড়িয়ে ও আমার কান সেই শেষ অট্টহাসিকে এখনো হাত বুলিয়ে যাচ্ছে ।





Posted By Debarati Datta Read about me here blogging since 2011 Copyright © Debarati Datta Privacy Policy